মানুষ কি আল্লাহর ইচ্ছায় বাঁধা তাকদির নিয়ন্ত্রিত রোবট?

এক. আল্লাহর ইচ্ছা ও মানুষের দায়বদ্ধতা

মনে করুন আপনি কোন পাওয়ার স্টেশন থেকে বিদ্যুত নিচ্ছেন এবং সেই বিদ্যুত আপনি ইচ্ছামত বিভিন্ন কাজে লাগাচ্ছেন।
১.১.১ বিদ্যুতের জন্য আপনি পাওয়ার স্টেশন যিনি চালাচ্ছেন তার মুখাপেক্ষী।
১.১.২ কিন্তু বিদ্যুত কী খাতে ব্যবহার করবেন সেটা আপনার ইচ্ছাধীন।

কাজেই,

১.২.১ বিদ্যুতের সঠিক/অপ ব্যবহারের জন্য আপনি নিজেই দায়ী, ‘পাওয়ার স্টেশন যিনি চালাচ্ছেন’ তিনি নন।
১.২.২ কিন্তু যেহেতু ‘পাওয়ার স্টেশন যিনি চালাচ্ছেন’ তার ইচ্ছা ব্যতীত আপনি বিদ্যুত পেতে পারেন না, সেহেতু একথা বলা যায়, বিদ্যুতের যে ইচ্ছামত ব্যবহার আপনি করছেন তা ‘পাওয়ার স্টেশন যিনি চালাচ্ছেন’ তার ইচ্ছাতেই করতে পারছেন।

কেউ যখন বলে “আল্লাহর ইচ্ছাতেই সবকিছু হয়”, তখন সবচেয়ে বড় যে ভুলটা সাধারণত হয় তা হলো আল্লাহর ইচ্ছাকে মানুষের ইচ্ছার মত কিছু একটা বিবেচনা করা হয়। বস্তুত আল্লাহর ইচ্ছা হচ্ছে আমাদের জন্য একপ্রকার শক্তি, যেই শক্তির বলে আমরা ইচ্ছা করতে পারি। আমরা তখনই কেবল ইচ্ছা করতে পারি যখন “আল্লাহর ইচ্ছা” আমাদেরকে ইচ্ছা করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে।
১.৩.১ ইচ্ছা করতে পারব কি না এই ব্যাপারে আমরা আল্লাহর ইচ্ছার ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। “আল্লাহর ইচ্ছা” তথা শক্তি ছাড়া আমরা কোন ইচ্ছাই করতে পারি না।
১.৩.২ কিন্তু ইচ্ছা করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি “আল্লাহর ইচ্ছা” কর্তৃক প্রাপ্ত হবার পর আমরা “কী ইচ্ছা করব”, সেই ব্যাপারে আমাদের স্বাধীনতা রয়েছে। [মানুষের ইচ্ছার স্বীকৃতি রয়েছে এমন কিছু আয়াত ১৮:২৯, ২৫:৫৭, ৭৬:২৯, ৭৩:১৯, ৭৮:৩৯, ৮০:১২, ৭৪:৫৫]

১.৩.১ এর ব্যাপারে আরেকটু ব্যাখ্যা:
আল্লাহ মানুষের ওপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপান না।
১.৩.১.১ যে সকল বিষয়ে মানুষ নিজ ইচ্ছাশক্তিকে স্বাধীনভাবে প্রয়োগ করতে পারে কেবল এবং কেবলমাত্র সেই সকল বিষয়েই মানুষকে দায়ী করা হবে।
১.৩.১.২ যে সকল বিষয়ে মানুষের ইচ্ছাশক্তির কোন স্বাধীনতা নাই, সেসকল বিষয়ে মানুষকে কস্মিনকালেও দায়ী করা হবে না।

কাজেই, যেসকল বিষয়ে মানুষকে পরীক্ষা করা হয়, সেসকল বিষয়ে যেহেতু মানুষ স্বাধীনভাবে ইচ্ছার প্রয়োগ ঘটাতে পারে, সেই বিষয়ে আল্লাহ কাউকে বাধ্য করেন না বা কারো ওপর কোন বিষয়কে চাপিযে দেন না, কাজেই এর দায়ভার মানুষের, আল্লাহর নয়।

দুই. তাকদিরের লিখন ও মানুষের স্বাধীনতা

কেউ যদি দাবি করে যে সে ভবিষ্যতের কথা জানে এবং তার এই জানার ভিত্তিতে সে একটা বই রচনা করে, কিন্তু সেই ভবিষ্যদ্বাণীকে বাস্তবতা দেবার জন্য সে কোন প্রচেষ্টা না চালায়, তাহলে তার ব্যাপারে দুইটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়:
২.১.১ যদি তার সব ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তব হয়, তবে বলা যাবে সে আসলেই ভবিষ্যত জানে।
২.১.২ যদি তার ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তব না হয়, তবে বলা যাবে সে আসলে ভবিষ্যত জানে না।

কিন্তু তার প্রতিটি ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাবার কারণে,
২.২.১ একথা বলা যাবে না যে, তার ভবিষ্যদ্বাণীর কারণেই কোন ঘটনা ঘটেছে।
২.২.২ বরং বলতে হবে, ভবিষ্যতের সঠিক জ্ঞান থাকার কারণেই সে ঘটনাটিকে আগেই লিখে রাখতে পেরেছে।

মানুষের কাজকর্ম কি তাকদির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নাকি লিপিবদ্ধ?

২.৩.১ কিছু বিষয় আল্লাহ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন এবং তা তাকদিরের কিতাবে লিখেও রেখেছেন। যেমন; কোন মানুষ কখন জন্মাবে, কখন মারা যাবে, সে কতটুকু রিযিক পাবে, ইত্যাদি। এসব বিষয় মানুষের সাধ্য/ক্ষমতা/ইচ্ছার অধীন নয়, বরং তাকদির দ্বারা লিপিবদ্ধ, নির্ধারিত এবং নিয়ন্ত্রিত। [উল্লেখ্য এসব বিষয়ে মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে না।]

২.৩.২ কিছু বিষয়ে আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছা প্রয়োগের ক্ষমতা/স্বাধীনতা দিয়েছেন। যেমন; ঈমান আনা বা না আনা, হালাল উপায়ে রিযিক অন্বেষণ করা বা হারাম উপায়ে করা, নেকি/বদির কাজ করা বা না করা, ইত্যাদি। এই বিষয়গুলোর জন্য মানুষকে জবাবদিহি করতে হবে। এগুলোও তাকদিরের কিতাবে লিপিবদ্ধ করা আছে, কিন্তু এগুলো তাকদির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়।

ইসলাম অনুসারে আল্লাহ সময়ের গন্ডিতে আবদ্ধ নন, রবং অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সকল জ্ঞান আল্লাহর রয়েছে। সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে আল্লাহ জানেন কখন মানুষ কী করবে। এই জানার ভিত্তিতে আল্লাহ তাকদিরের কিতাবে লিখে রেখেছেন মানুষ কী কী করবে।

২.৩.২.১ ইসলাম একথা বিশ্বাস করতে বলে যে, আল্লাহ তার ইলমের দ্বারা জানেন মানুষ কী করবে, তা তিনি তাকদিরের কিতাবে লিখে রেখেছেন। এটা নিছক আল্লাহর এলেম সংক্রান্ত একটা বিশ্বাস বা স্বীকৃতি। পূর্ব নির্ধারণের সাথে সম্পৃক্ত কিছু নয়। স্রষ্টা বলে অনাদি, অনন্ত, সর্বজ্ঞ কেউ থাকলে তিনি সময়ের অধীন হতে পারেননা এবং অতীত, বর্তমান ভবিষ্যতের সব জ্ঞান তার থাকতেই হবে। সেই জ্ঞান তিনি লিপিবদ্ধ করবেন কি করবেন না, সেটা তার ইচ্ছা। সেটা লিপিবদ্ধ করা বা না করার দ্বারা কারো ওপর কিছু আরোপিত হয় না।

২.৩.২.২ ইসলাম একথা বিশ্বাস করতে বলে না যে, আল্লাহ তাকদিরের কিতাবে লিখে রেখেছেন বলেই আমরা পৃথিবীতে সব কাজ করি, বা আল্লাহ by force আমাদেরকে দিয়ে তাকদিরের কিতাবের লিখিত বিষয়বস্তুর অভিনয় করাচ্ছেন আর আমরা রোবটের মত অভিনয় করে যাচ্ছি। [অথচ আমরা অনেকে তাকদিরকে সেটাই মনে করি, আর সেখানেই আমাদের ভুল।]

কাজেই, যেসব বিষয়ে আমাদের পরীক্ষা করা হয়, তা তাকদির দ্বারা নির্দিষ্টকৃত/নিয়ন্ত্রিত নয়, বরং আল্লাহর এলেমের দ্বারা লিপিবদ্ধ মাত্র।

যার ইচ্ছা, বিশ্বাস স্থাপন করুক এবং যার ইচ্ছা অমান্য করুক।
যে ইচ্ছা করে, সে তার পালনকর্তার পথ অবলম্বন করুক।
প্রত্যেক ব্যক্তি তার কৃতকর্মের জন্য দায়ী। [যথাক্রমে ১৮:২৯, ২৫:৫৭, ৭৪:৩৮ আয়াতের প্রাসঙ্গিক অংশ]

মুল লেখকঃ ভাই সাদাত, সদালাপ ব্লগ

Leave a comment